একজন নগর বাউল।


একজন নগর বাউল। 


"গুরু জেমস"
পুরো নাম ফারুক Mahfuz Anam James । জন্ম ১৯৬৪ সালের ২ অক্টোবর; উত্তর বঙ্গের নওগাঁ জেলার পত্নীতলায়।

তাঁর বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরেজীবি। সেই সুবাধে ছোট বেলা থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকতে হয়েছে। তাঁর বাবা যখন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারমান, তখন সেই চট্টগ্রাম থেকেই জেমসের সঙ্গীত জীবনের পাগলামি শুরু।

 ৯ম শ্রেণী পড়া অবস্থায় বাবা তাঁর বখে যাওয়া সন্তানকে একদিন ঘর থেকে বের করে দেয়। আশ্রয় নেয় 'আজিজ বডিং এ"! সেই সময় চট্টগ্রামের “আজিজ বোর্ডিং” হয় তার গানের কারখানা ।

জেমসের উপর ক্ষুব্ধ থাকা তাঁর সেই স্বর্গীয় পিতা নিশ্চয় আজ স্বর্গ থেকে ছেলের সফলতা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। তিনি যাকে শিক্ষিত করে তাঁর মতো বড় কোন সরকারী কর্মকর্তা বানাতে চেয়েছিলেন, আজ হয়তো তার সেই দুঃখ নেই। কারন তার ছেলে আজ দেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের গুরু হয়ে সমগ্র উপমহাদেশে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

.. ১৯৮৭ সালে বের হয় জেমস এর প্রথম একক
অ্যালবাম “অনন্যা”। যার সবগুলো গান ছিল ব্যতিক্রম। গানগুলোতে ছিল সদ্য টগবগে এক তরুনের মিষ্টি মধুর পরিশীলিত সুর।

১৯৮৮ সালে জেমস চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ব্যান্ড 'ফিলিংস' এ যোগ দেন। তখন কুমার বিশ্বজিৎ বিহীন 'ফিলিংস' হয়ে উঠেছিলো দিশেহারা। সে সময় ঘর ছাড়া জেমস যোগ দেয় 'ফিলিংস' ব্যান্ডে। ব্যান্ডের অনুশীলন থেকে শুরু করে থাকা ,খাওয়া সব হতো সেই “আজিজ বোর্ডিং”। সেই এক কামরায় সব ব্যান্ড সদস্যদের কত বিনিদ্র রাত কেটেছে, শুধু গান তৈরির নেশায়!

১৯৮৯ সালে বের হয় “ফিলিংস’ এর ১ম অ্যালবাম “স্টেশন রোড”। সেই অ্যালবামের “ঝর্না থেকে নদী”, “স্টেশন রোড” “দুঃখ কেন কররে মন” “আমায় যেতে দাও” “রুপসাগরে ঝলক মারিয়া” “সত্যই সুন্দর” সহ সবগুলো গানই ছিল অপূর্ব। যেখানে জেমস এর নীরব
হাহাকার, প্রেমের আকুতি,অন্যায়ের প্রতিবাদ সব কিছু ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত সুন্দর ভাবে।

১৯৯২ সালেই জেমস ভালোবেসে বিয়ে করেন মডেল ও অভিনেত্রী রথি কে, এবং ২০০১ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পরবর্তীকে বেনজীর কে বিয়ে করেন।

 ১৯৯৩ সালে আবার চুপচাপ থাকা জেমস “ফিলিংস” শ্রোতাদের সামনে নিয়ে আসেন “জেল থেকে বলছি “ অ্যালবাম। মুলত এই অ্যালবাম দিয়ে নতুন দশকের শ্রোতাদের কাছে জেমস ও ফিলিংস এর পরিচয় ঘটে। সেই “জেল থেকে বলছি’ এক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর করুন অনুভুতি ও আর্তনাদ নিয়ে জেমস তার আসন পাকাপোক্ত করে নেন।
তখন ব্যান্ডের কনসার্টে জেমস কে পাওয়া মানে শ্রোতাদের অন্যরকম উম্মাদনা।

১৯৯৫ সালে বের হয় জেমস এর ২য় একক অ্যালবাম “পালাবে কোথায়”। যেটি ছিল এক প্রেমিকার কাছে প্রেমিকের কঠিন প্রশ্ন ! এই অ্যালবাম টিও তখন খুব শ্রোতা প্রিয়তা পায়। জেমস তখন হয়ে যায় “গুরু জেমস”। যেন নতুন যুগের এক কাণ্ডারি। যে কিনা যেমন নাচাতে চায় শ্রোতাদের, শ্রোতারাও তেমনি নাচে। 

ব্যান্ড শ্রোতারা তখন দুই পক্ষ- একদল  “জেমস এর ভক্ত” অন্যদল “জেমসের বিরোধী”।
এই অনিবার্য সংঘাত এড়ানোর জন্যই সেই ফেলে আসা ৯৬ তে জেমস আরও একটি চমৎকার উপহার দেন- “নগর বাউল” এলবাম। যেখানে “মান্নান মিয়ার তিতাস মলম” , “আমি এক নগর বাউল”, “আমি তারায় তারায় রটিয়ে দিবো”, “নাগ নাগিনির খেলা” “হুমায়রা নিঃশ্বাস চুরি হয়ে গেছে” এর মত জনপ্রিয় গানগুলো ছিলো।

পর পরে আবার একক অ্যালবাম “দুঃখিনী দুঃখ করোনা”। যা দিয়ে তিনি তাঁর বিপক্ষের ভক্তদের একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দেন। সেই অ্যালবামের সবগুলো গান এতোটাই জনপ্রিয় হয় যে তার বিরোধী শিবিরের
লোকেরাও সবাই তার ভক্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে “যদি কখনও ভুল হয়ে যায়” গানটি জেমস এর সর্বকালের সেরা একটি গানে পরিণত হয়। যে গানে জেমস এর আবেগ এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে কোন মানুষের চোখে জল আনতে বাধ্য করতো!

৯০ দশকেই জেমস ও ফিলিংস নিয়ে আসে “লেইস ফিতা লেইস” অ্যালবামটি (যেটি ছিল ফিলিংস নাম নিয়ে সর্বশেষ অ্যালবাম)।
যে অ্যালবাম এ “পথের বাপ” “বায়স্কোপ” “সিনায় সিনায়” “হাউজি” “পুবের হাওয়া” “লেইস ফিতা” “নিরান্নব্বই নামে তিনি” সহ সবগুলো গান চরম শ্রোতাপ্রিয়তা পায়।
যার ফলে “গুরু” নামটি জেমসের সাথে পাকাপোক্ত ভাবে বসে যায়।

তখন জেমস ছিল অবাধ্য ও বিশৃঙ্খল তরুণদের শান্ত করার এক যাদুকর। জেমস কন্সার্টে আসা আগ পর্যন্ত যে তরুণরা তাকে দেখার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে থাকতো, তাদের উদ্দেশে মঞ্চে উঠেই জেমস বলতেন- ”তোরা শান্ত হয়ে যা! আমি এসে গেছি!” ব্যস, সবাই সেই
যাদুকরের কথায় শান্ত হয়ে যেত, আর তার গান গুলোতে ঠোঁট মিলিয়ে গাইত।

তখন গুরু জেমস কে শ্রোতারা যেভাবে পেয়েছিললো এখন তার কোন ছিটেফোঁটাও  পায়না। বিশেষ করে সেই সময় জেমস এর ফিলিংস,নগরবাউল ও একক অ্যালবাম ছাড়াও প্রতিটি মিক্সড অ্যালবাম এ গাওয়া গানগুলো!

তখনকার সেরা সব গীতিকার যারা ছিলেন, তাঁর মধ্যে- লতিফুল ইসলাম শিবলি, বাপ্পি খান, দেহলভি, আনন্দ, তরুন মুন্সি, মারজুক রাসেল, গোলাম মোরশেদ, প্রিন্স মাহমুদ ও জুয়েল-বাবু, জেমস এর জন্য আলাদা ভাবে গান লিখতেন। যে গানের কথাগুলো ছিল একটার
চেয়ে আরেকটা অসাধারণ। যা একবার শুনে মন ভরতো না। শ্রোতারাও দ্বিধায় পড়ে যেতেন কোন গান থেকে কোন গান বেশি সেরা এই নিয়ে আড্ডায় তুমুল
তর্ক চলতো। যেটা এখনও চলে।

এছাড়াও জেমস সব শ্রেণীর শ্রোতাদের মনে যায়গা করে নিয়েছে "বাবা", "মা" "স্যার", "বাংলাদেশ" "দেখে যারে তুই" "কবিতা" সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়ে। জেমসের "পাগলা হাওয়ার তরে" গানটি  দেশের জনপ্রিয় গানের দ্বিতীয় স্থানে ছিলো। (প্রথম, আসিফের "ও প্রিয়া তুমি কোথায়!)...

 জেমস এর আরো অন্যান্য অ্যালবামগুলো-
-ঠিক আছে বন্ধু (একক)
-দুষ্ট ছেলের দল (নগর বাউল)
-আমি তোমাদেরই লোক (একক)
-জনতা এক্সপ্রেস( একক)
-কাল যমুনা (একক)
-তুফান (একক)

আজ 'জেমস' বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশেরও একটি প্রিয় কণ্ঠের নাম। যিনি উপমহাদেশের মাঝে কন্ঠের জোরে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও প্রমাণ করেছেন যে- 
ভারতের শিল্পীরাই শুধু হিন্দি গানের প্লেব্যাক এ সেরা নয়..  সুযোগ পেলে বাংলার শিল্পীরাও কাঁপিয়ে দিতে
পারে।

একারনেই ‘জেমস’ অন্য সবার চেয়ে আলাদা ও চিরস্মরণীয় একজন। যাকে বাদ দিয়ে কোনদিন বাংলাদেশের পূর্ণ সঙ্গীত ইতিহাস লিখা সম্ভব নয়। কেউ যদি তা লিখার দুঃসাহস দেখায়, আমি নিশ্চিত তার লিখা সেই ইতিহাস কেউ গ্রহন করবে না।

[ কিছু তথ্য গুগল থেকে নেওয়া]

Comments

Popular posts from this blog

আমার প্রানপ্রিয় গ্রাম সৈয়দপুরের ইতিহাস।

My personal blog Site

ক্বীন ব্রীজ সিলেটের সুরমা নদীর উপর লৌহ নির্মিত সেতু